সময়ের
পালাবদলের সাথে বদলে যাচ্ছে রুচি ও ফ্যাশন ভাবনা। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, কখনও ফ্যাশনে এসেছে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসভরা অনেক অনুষঙ্গ
নিয়ে। আবার কখনও বা হারিয়ে গেছে। দুনিয়াজুড়ে ফ্যাশন নিয়ে কত কী হৈচৈ হয়। আর এই হৈচৈ
এর মাঝে যোগ হয়েছে এক নতুন ট্রেন্ড বা কালচারও বলা যেতে পারে। সে হল ট্যাটু কালচার।
লো-কাট কুর্তির ফাঁক
দিয়ে উঁকি মারছে ঘাড়ের কিম্বা কাঁধের তারা। কিংবা কলার বোনের নিচে রঙিন একটি
প্রজাপতি। আবার কারও ক্যাপ্রির নিচে গোড়ালি থেকে একটু উপরে একটি নীল পরী। কিংবা
হাতে কোনও অলঙ্কার নয়; কব্জির
উপরে এরকমই কোনও পছন্দসই আঁকিবুকি। আজকের জেনারেশনের কাছে এই আঁকিবুকিই হয়ে উঠেছে
প্রকাশের মাধ্যম। অনেক দিন থেকে ফ্যাশন প্রিয় নারী-পুরুষের অনেকেই এই ট্যাটু
কালচারে ঝুঁকেছেন। আজকাল এটা অনেকের কাছে ক্রেজ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নিজেকে
অন্যের কাছে আবেদনময় এবং আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনার জন্য গায়ে এঁকে নিচ্ছেন ট্যাটু। পোশাকি নাম ট্যাটু। যাকে আবার উল্কিও বলা হয়। যা আবার ‘মার্ক’ নামেও পরিচিত।
ট্যাটু নামের এই জিনিসটি
বর্তমানে ফ্যাশন জগতে সাড়া ফেললেও, আসলে
এই ট্যাটু কিন্তু কয়েক হাজার বছরের পুরনো। ট্যাটু নামটারও রয়েছে উৎসের ইতিহাস।
কিন্তু ইতিহাসের এক ধরনের প্রথা বর্তমানে ফ্যাশন জগতের নতুন আর এক নাম।
শরীরে ট্যাটু
আঁকার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে শুরু করে অপরাধী সনাক্তকরণ ও নিজেদের বিশিষ্টতা প্রমাণেও আঁকা হতো ট্যাটু। কিছু দিন আগে ফ্রান্সের প্যারিসে
একটি ব্যতিক্রমী প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়েছে মানুষের ট্যাটু চর্চার ইতিহাস।
বেশিরভাগ আদিম সংস্কৃতিতেই ছিল ট্যাটুর ব্যবহার। ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে
অতিপ্রাকৃতিক শক্তিকে তুষ্ট করতে শরীরে আঁকা হতো ট্যাটু। ধারণা করা হতো এসব
ট্যাটুর রয়েছে যাদুকরী শক্তি, যা রক্ষা করবে এর ধারককে। অনেক সংস্কৃতিতেই
ট্যাটু ছিল সামাজিক মর্যাদার বিষয়। বিশেষ করে মাও সে তুংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের
সময় নিষিদ্ধ হওয়ার আগে চীনের সম্ভ্রান্তদের মধ্যে ব্যপকভাবে প্রচলিত ছিল ট্যাটুর
ব্যবহার। ট্যাটু আঁকার
একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চিকিৎসা। এছাড়া, যাদুবিদ্যার জায়গা থেকেও আঁকা
হতো ট্যাটু। ধারণা করা হতো এটা দুষ্ট আত্মাদের কুনজর থেকে রক্ষা করবে।মৃত্যুর পরের জীবনে সুবিধার জন্য ছাড়াও সামষ্টিক পরিচয় বা ব্যক্তিগত রূচি ও সৌন্দর্যবোধের জায়গা থেকেও ট্যাটু এঁকেছে মানুষ।
ইতিহাস বলছে, এই ট্যাটুর প্রথম প্রচলন
কোথায়,
কবে, কীভাবে হয়েছে, সে সম্পর্কে মতামত অনেক।
ইতিহাস বলছে, শতাব্দী
প্রাচীন এই ট্যাটু পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের আদিবাসীদের কাছেও খুব জনপ্রিয় ছিল।
রাজা থেকে সাধারণ প্রাচীন ইজিপ্ট, গ্রিনল্যান্ড, সাইবেরিয়া, নিউজিল্যান্ড- সর্বত্রই
এই ট্যাটুর প্রচলন ছিল বলে জানা যা। এটি প্রায় ৩০০০ থেকে ২০০০ বিসির কথা। বলা হয়, ৩০০০ বিসির এক মমির দেহে
ইতিহাসবিদরা এই ধরনের মার্ক আবিষ্কার করেন। ইতিহাস আরও বলে, পরে ১৭৬৯ সালে
ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন জেমস কুক সাউথ প্যাসিফিকে জাহাজের নাবিক এবং ব্যবসায়ীদের
মধ্যে এই ট্যাটু দেখতে পান। এঁদের কাছ থেকেই ইউরোপ এবং আমেরিকায় ফ্যাশন হিসেবে
ট্যাটু ছড়িয়ে পড়ে।
বিংশ, একবিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন দেশের আদিবাসীদের মধ্যে পশুর হাড়, কিংবা বাঁশের সরু ফালি
কিংবা নানা ধারাল জিনিস দিয়ে স্কিনের উপর কেটে কেটে ডিজাইন তৈরি করা হত। কোথাও
পুরো মুখে, কিংবা
শরীর জুড়ে এই ট্যাটুর প্রচলন ছিল। তখনই এই
ট্যাটু ‘আর্টের’ জন্ম।
এক সময় বিভিন্ন জাতি
নিজেদের আলাদা করে চিহ্নিত করতে সকলে একই ধরনের ট্যাটু নিজেদের শরীরে আঁকত। আবার
নাৎজিদের আলাদা করে চিহ্নিত করতে হিটলার তাদের হাতে জোর করে এক ধরনের মার্ক করে
ট্যাটু আঁকান বলে জানা যায়। এক একসময় ট্যাটুর প্রচলন আলাদা ভাবে প্রয়োগ হলেও আশি
এবং নব্বইয়ের দশকে ইউরোপ এবং আমেরিকায় ট্যাটু ফ্যাশন হিসাবে নতুন করে জায়গা করে
নেয়। আরও একটু পরে হয়ে ওঠে লেটেস্ট ফ্যাশন বা স্টাইলের মাধ্যম। সম্প্রতি এক
জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের একজনের
গায়ে অন্তত একটি করে ট্যাটু আঁকা রয়েছে। আধুনিক সময়ে এসে ট্যাটুর ব্যবহার যে
ক্রমেই বাড়ছে এটা তারই প্রমাণ।
Facebook এর আমাদের সঙ্গে থাকুন।